তারা জানিয়েছেন, গত চার দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাত কোটি টাকার ফুল গেছে এবং বাকি তিন দিনে আরও ১৩ কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা সকলের।
আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস, ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন, বাঙালির বসন্ত বরণ উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা ও মহান ভাষা দিবসকে সামনে রেখে প্রতিবছরই যশোর অঞ্চলের ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীদের আগাম প্রস্ততি থাকে।
করোনা পরিস্থিতিতে হলেও এবার গতবারের তুলনায় আশা জেগেছে ফুল চাষিদের মাঝে। তাছাড়া পদ্মা সেতু দৃশ্যমাণ হওয়ায় এবার ফুল বিক্রির পরিমাণ যেন হঠাৎ করেই কিছুটা বেড়েছে।
গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘গদখালীর ৪০ শতাংশ ফুল ঢাকা ও চট্টগ্রাম এবং ৬০ শতাংশ ফুল চালানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোটবড় বাজারে পাঠানো হয়। ওই সব চালানের হিসাব অনুযায়ী গত শুক্রবার পর্যন্ত সাত কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে।’
সরেজমিনে গদখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি গোলাপ ৫-৭ টাকা, জারবেরা ১০-১৬ টাকা, গ্লাডিওলাস ৩ থেকে ৬ টাকা, রজনীগন্ধা ৫/৬ টাকা এবং গাঁদা প্রতি হাজার দেড় থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা ‘ফুলের রাজধানী’ গদখালীতে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর যশোর জেলায় ৬০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার কৃষক।
তবে, কৃষি বিভাগের তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বলেন, ১৪০০ থেকে ১৫০০ হেক্টর জমিতে এবার ফুলের চাষ হয়েছে। আর ফুল চাষে সম্পৃক্ত আছেন ছয় হাজার কৃষক।
যশোর অঞ্চলের চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে ফুলের আবাদ ও ব্যবসা বেশ লাভজনক। এখানে ফুল চাষি, পাইকরি ও খুচরা বিক্রেতা ছাড়াও এই খাতে অটোভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, ছোট পিকআপ মালিকরা জড়িত আছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের চাষি আমিনুর রহমান জানান, গত চার দিনে ৩ লাখ টাকার জারবেরা ফুল বিক্রি করেছেন।
ভোরে জমে উঠা ফুলের বাজার
গত চার দিন গদখালী বাজারে ভোরে চাষিরা প্রচুর পরিমাণে গোলাপ, গাঁদা, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চায়না লং স্টিক রোজ প্রভৃতি ফুল নিয়ে আসেন। বাজারে জায়গা না হওয়ায় তাদের অনেককেই আবার ফুল নিয়ে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের উপর বসছেন। সকাল ১০টার মধ্যেই সব ফুল কিনে ব্যবসায়ীরা ট্রাক কিংবা বাসের ছাদে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে নিয়ে যাওয়া হয় বা পাঠিয়ে দেন।
উল্লেখ্য, যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী বাজার। দেশে ফুলের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করে থাকেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।
আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফুল চাষ
ফুলের রঙে রঙিন ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালীতে ফুলের বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। কয়েকটি উৎসবকে লক্ষ্য করে এখন ফুলের ভরা মৌসুমে তোড়জোড় ও ব্যস্ততা উভয়ই বেড়েছে তাদের।
নতুন জাতের ফুল
তিন বছর আগের বসন্তবরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন উপহার হিসেবে এনেছিলেন লং স্টিক রোজ।
ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষ ধরনের গোলাপের জাতটির চাষ শুরু করেছিলেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা গদখালীর ইনামুল হোসেন।
এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য জাতের গোলাপ গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ রাখা যায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। এর স্টিক বেশ শক্ত। দামও মিলছে দ্বিগুণ।
এসব কারণে ইনামুলের দেখাদেখি এ অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষির মাঠে গোলাপের নতুন এই জাতটি শোভা পাচ্ছে।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস: শত কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে যশোরের ফুল চাষিরা
এবার নতুন জাতের ফুল উপহার দিতে না পারলেও এখানকার চাষিরা ফুলপ্রেমীদের দিচ্ছেন চমকপ্রদ খবর। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জারবেরা চারায় ফুল ফোটাচ্ছেন তারা। অল্প অল্প করে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এতদিন বেঙ্গালুরু থেকে চারা এনে জারবেরা চাষ করতেন চাষিরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরআরএফ যশোরের টিস্যু কালচার সেন্টার জারবেরার চারা তৈরি করছে।
লং স্টিক রোজের পাশাপাশি গদখালী-পানিসারা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্র মলিল্গকাসহ হরেক রকমের ফুল। বাতাসে ফুটন্ত ফুলের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় ফুলের হাসি লেগেছে চাষিদের চোখেমুখেও।
পানিসারার ফুলচাষি সাহিদা বেগম বলেন, চাষিরা গোলাপের কুঁড়িতে এখন ক্যাপ পরিয়ে রেখেছেন, এতে ফুল একটু দেরিতে ফোটে। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায়, তাহলে মুনাফাও হবে ভালো।
জারবেরা ফুল ব্যবসায়ী আলম হোসেন বলেন, এখন প্রতি সপ্তাহে ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। উৎসব সামনে রেখে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
গদখালীর ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, পৈতৃক জমিতে তিনি আগে ধান-পাট ও রবি শস্যের আবাদ করতেন। এখন সেখানে ফুল চাষ করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
বিদেশে ফুল রপ্তানি
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, এবার জেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়।
দেশের গন্ডি পেরিয়ে ফুল এখন যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও ফুল রপ্তানি হচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: করোনায় স্বপ্নভঙ্গ ফরিদপুরের ফুল চাষিদের
অন্যদিকে, ইউরোপের বাজারে ফুল রপ্তানির আশায় পলি হাউসে ফুলের আবাদ করছেন এখন চাষিরা।
তারা বলছেন, পলি হাউসে তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ ফুল উৎপাদন হবে।
গদখালী ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, এই ফুলকে কেন্দ্র করে সারা দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই ছয় হাজার ফুলচাষি রয়েছেন।
দাম ভালো পাওয়ার কারণে এবার ফুল বিক্রি পরিমান ৩০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গদখালীতে বাণিজ্যিক ফুল চাষের শুরুর গল্প
দেশে ফুলের বিশাল এই বাণিজ্য প্রথম শুরু হয়েছিল জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারায় আশির দশকে।
ফলদ ও বনজ গাছের নার্সারির মালিক শের আলী গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন ফুল চাষের। সেই শুরু এখন দক্ষিনাঞ্চলে লাখো পরিবারের আয়ের ফুল খাত হিসেবে স্বীকৃত।
শের আলীর পৈতৃক ব্যবসা ছিল নার্সারি। তিনি ফলদ ও বনজ গাছের চারা উৎপাদন ও বিপণন করতেন। যশোর-বেনাপোল সড়কের গদখালীতে ছিল তার সেই নার্সারিটি। সেখানে বসে আলাপকালে নূর ইসলাম তাকে ফুল চাষের পরামর্শ দেন। ভারত থেকে এক বস্তা রজনীগন্ধার বীজ এনে দেন। ওই বীজ দিয়ে তিনি পানিসারা গ্রামের নিজের ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধার চাষ শুরু করেন।
শের আলী বলেন, ‘প্রথম যখন ফুলের চাষ শুরু করেছিলাম, লোকজন আমাকে পাগল বলত। ধান-পাট আবাদ না করে ফুল চাষে হাস্যরসের খোরাক হয়েছিলাম সবার কাছে।’
আরও পড়ুন: ‘ফুলের রাজ্য’ সাবদি, ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট
তবে প্রথম চালান দুই লাখ টাকায় বিক্রির পর তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তারপর থেকে আস্তে আস্তে একের পর চাষি ফুল চাষে নাম লেখান।
এখন পুরো অঞ্চলে ফুলের আবাদ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে শের আলী বলেন, ব্যাপারটা আর কিছু নয়। পাশাপাশি বসবাস ও দেখাদেখি চাষ। বিষয়টা এমনি। অর্থাৎ ফুল চাষে তার আকাশচুম্বী লাভ দেখে পাশের কৃষক এদিকে ঝুঁকে পড়েন।
প্রথম ফুল আবাদে সফল হওয়ার পর উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে এলাকার ১২ জন কৃষকের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
এরপর থেকে একসঙ্গে পথচলা শুরু হয় ১২ ফুলচাষির। তাদের ফুলের ওপর ভরসা করে ঢাকার শাহবাগে গড়ে ওঠে মালঞ্চ নামে রাজধানীর প্রথম ফুলের দোকান। ৩০ শতক জমি দিয়ে শুরু করা ফুলচাষের পরিধি বেড়ে এখন ১০ বিঘা হয়েছে।
তার তত্ত্বাবধানে বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায় ফুল চাষের খামার গড়ে তুলছেন বলেও জানান শের আলী।